স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম:-(৩) কোয়ান্টাম ল্যাব

  • নিরাপদ রক্তের নিশ্চয়তা
  • রক্তদাতাদের সেবায়
  • ল্যাব কমিউনেকশন

আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় রক্তের একটি বড় অংশই আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। আর পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের অধিকাংশই সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি বা এইডসে আক্রান্ত। ফলে এই দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালিত হয়ে রক্তগ্রহীতাও প্রায়শই আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। দূষিত রক্তের অভিশাপ থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষা করার জন্যে নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের প্রয়োজনীয়তা এখন সচেতন মানুষ বুঝতে পেরেছেন। তাই তারা এগিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছা রক্তদানে। এ কার্যক্রমে যত বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এগিয়ে আসবে তত দ্রুত আমরা দূষিত রক্তের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো। দেশের প্রবীণ রক্ত পরিসঞ্চালনবিদ প্রফেসর ডা. মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালের ১০ জুন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সূচনা করেন। ১৯৭৮ সালে সন্ধানী এবং ১৯৮১ সালে রেড ক্রিসেন্ট এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশে স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে এগিয়ে এসেছে অরকা (১৯৮২), বাঁধন (১৯৯৭) বা লায়ন্স বাংলাদেশের মতো রক্ত সংশ্লিষ্ট সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। এই পথ ধরেই ১৯৯৬ সালে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৯৬ সালে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিজস্ব ল্যাব। ২০০৩ সালে সংযোজিত হয় রক্তের কম্পোনেন্ট সেপারেটর (সেন্ট্রিফিউজ মেশিন), স্ক্রিনিংয়ের জন্যে আধুনিক এলাইজা মেশিন, -৯০ ও -৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ডিপফ্রিজ এবং প্লাটিলেট সংরক্ষণের জন্যে প্লাটিলেট ইনকিউবেটর। ২০০০ সালে ল্যাবের কার্যক্রম শুরু করার পর যেখানে প্রথম বছরে রক্ত সরবরাহ করা হয়েছিলো ১,৫৬৪ ইউনিট সেখানে ২০১২ সালে ল্যাব থেকে প্রতিমাসে গড় সরবরাহকৃত রক্ত ও রক্ত উপাদান ৬৫০০ ইউনিটেরও বেশি।

কোয়ান্টাম ল্যাব প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত পাঁচটি মৌলিক স্ক্রিনিং সম্পন্ন করে রক্ত প্রদানের ব্যাপারে আপসহীন মনোভাব নিয়ে কাজ করে আসছে। রক্তে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস, এইডস বা ম্যালেরিয়া ইত্যাদি যেকোনো একটি জীবাণুর উপস্থিতি সম্পর্কে কোনোরকম সংশয় বা প্রশ্ন দেখা দিলে সে রক্তের ব্যাগ সাথে সাথে বাতিল ও ধ্বংস করা হয়।

নিরাপদ রক্তের নিশ্চয়তা

  • প্রতি ইউনিট রক্ত ও এর উপাদান স্বেচ্ছা দান।
  • FDA অনুমোদিত উন্নতমানের (CPDA-1) ব্যাগে সযত্নে সংগৃহীত ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষিত।
  • নিখুঁত ক্রস-ম্যাচিং অর্থাৎ থ্রি-ফেজ কম্প্যাটিবিলিটি (কক্ষ তাপমাত্রায়, ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ইনডাইরেক্ট কুম্বস টেস্ট) টেস্ট করা হয়।
  • নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক ল্যাব-এ রয়েছে সেল সেপারেটর সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, -৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ডিপ ফ্রিজ, প্লাটিলেট ইনকিউবেটর এবং এলাইজা মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি।
  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নির্ধারিত মৌলিক ৫টি স্ক্রিনিং (হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইডস এবং ম্যালেরিয়া) বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা হয়। ফলে ল্যাব থেকে সরবরাহকৃত রক্তের ব্যাপারে সারা দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এখন পুরোপুরি আস্থাশীল।

রক্তদাতাদের সেবায়

  • প্রতিবার রক্তদানের পর রক্তদাতা উপহার হিসেবে পাচ্ছেন রক্তবাহিত ৫টি রোগের (হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইডস এবং ম্যালেরিয়া) স্ক্রিনিং রিপোর্ট।
  • রক্তদাতা রক্তদানের পরই পাবেন ডোনার কার্ড।
  • রক্তদাতা নিজ দেহের প্রয়োজনে জমাকৃত প্রতি ব্যাগ রক্ত ফেরত পাবেন কোনো প্রসেসিং খরচ ছাড়া। অতিরিক্ত (সঞ্চিত রক্তের সমপরিমাণ) প্রতি ইউনিটে প্রসেসিং খরচ মাত্র ৫০%।
  • রক্তদাতা তার মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানের জন্যে প্রসেসিং খরচে (সঞ্চিত রক্তের সমপরিমাণ) ছাড় পাবেন ২০%।
  • তিনবার রক্তদান করার পর আজীবন রক্তদানের প্রতিশ্রুতি দিলে রক্তদাতা পাবেন সিরামিকসে মুদ্রিত সুদৃশ্য সম্মাননা স্মারক এবং বিশেষ আইডি কার্ড ও সনদপত্র।
  • ১০ বার রক্তদান করে লাইফ লং ব্লাড ডোনার সিলভার ক্লাব-এর সদস্য হলে রক্তদাতা পাবেন বিশেষ সম্মাননা মেডেল, আইডি কার্ড ও সনদপত্র।

ল্যাব কমিউনেকশন

কোয়ান্টাম ল্যাবে রয়েছে কমিউনিকেশন অর্গান নামে অত্যন্ত গতিশীল একটি অর্গান যাদের কাজ হলো ১ম বার রক্তদাতাদের ২ য় বার রক্তদাতায় রূপান্তরিত করা। ২য় বার রক্তদাতাদের ৩য় বার রক্তদাতায় রূপান্তরিত করা এবং এইভাবে তাকে একজন নিয়মিত ডোনারে পারিণত করা যার ফলে তিনি একসময় নিজের তাগিদেই ল্যাব এসে রক্ত দিয়ে যাবেন। এই অর্গানে এখন রয়েছে মোট ১৫ জন দক্ষ ফোন কমিউনেকটর যারা ডোনার ডাটাবেজের তথ্য থেকে প্রতি ৪ মাস পর পর ডোনারদের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন। তাদের কুশল জিজ্ঞাসা, জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো এবং সময় হলে ল্যাবে এসে রক্ত দেয়ার আহবান জানান। তাছাড়া যারা রক্ত দিয়ে গেছেন তাদের স্ক্রিনিং রিপোর্টও তারা জানিয়ে দেন ফোনে। কারো কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে তাকে ল্যাবে এসে ফ্রি মেডিকেল সার্ভিসের সেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ সেবা অবশ্য ডোনারদের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের জন্যেও দেয়া হয়। অর্থাৎ মূল বিষয়টি হচ্ছে ডোনারদের সাথে একটি নিয়মিত যোগাযোগ এবং সম্পর্ক সৃষ্টি করা যা তাকে কোয়ান্টামের সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করবে।

ব্লাড ক্যাম্প

কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের রক্তের একটা বড় অংশই আসে ব্লাড ক্যাম্প থেকে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩০৯টি ক্যাম্প। ল্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৩ বছরে বাংলা একাডেমী, লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বিভিন্ন মার্কেট, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সহযোগিতায় আয়োজিত এসব রক্তদান ক্যাম্পে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্ত দিয়েছেন হাজার হাজার রক্তদাতা।

প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বছরের বিশেষ দিনগুলোতে যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ১লা বৈশাখ, নজরুল জয়ন্তী, পবিত্র আশুরা এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে ক্যাম্প আয়োজন করা হয়।

গত ১০-১২ জানুয়ারি, ২০১৪ স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনের ওপর ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয় ব্লাড কনফারেন্স এন্ড ওয়ার্কশপ। শিলিগুড়িভিত্তিক স্বেচ্ছারক্তদান সংগঠন, শিলিগুড়ি সূর্যনগর সমাজকল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত ৩ দিনব্যাপী এ জাতীয় কনফারেন্সে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হন কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের ৪ জন প্রতিনিধি - অর্গানিয়ার রাবিয়া নাজরীন, ইঞ্জিনিয়ার প্রাঞ্জিত লাল শীল, জিয়াউল ইসলাম এবং শামীমা নাসরীন।

ভারতের ১৪ টি প্রদেশ থেকে সমবেত শতাধিক স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মী ও বিশেষজ্ঞ ছাড়াও এ কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ব্লাড ডোনেশন অর্গানাইজেশন (IFBDO) র প্রেসিডেন্ট জিয়ানফ্রান্কো মাসারো।

স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনের নানাদিক নিয়ে ৩ দিনব্যাপী এ সম্মেলনে আলোচনা করেন প্রবাদপ্রতিম স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলন সংগঠক, পশ্চিমবঙ্গ স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনের জনক, AVBD, WB এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর দেবব্রত রায়। আরো ছিলেন AVBD তামিলনাড়ুর শ্রী আর রাজকুমার, ইন্ডিয়ান রেডক্রস সোসাইটি আহমেদাবাদের উপদেষ্টা শ্রী মহেশ সি ত্রিবেদী এবং ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (NACO) র ডিরেক্টর মিস বিনীতা শ্রীবাস্তব প্রমুখ।

কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের পক্ষ থেকে এ সেমিনারে একটি বিশেষ নিবন্ধ পাঠ করেন অর্গানিয়ার রাবিয়া নাজরীন। দেখানো হয় QVBDP এর ওপর নির্মিত দুটি বিশেষ ভিডিও ডকুমেন্টারি। প্রেজেন্টেশন এবং ভিডিও প্রদর্শনী দুটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। অনেকেই বাংলাদেশ এবং কোয়ান্টামের কার্যক্রম সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং বিস্তারিত জানতে চান।

ভবিষ্যতে রক্তদান কার্যক্রম নিয়ে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন তারা।

No comments:

Post a Comment