চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণই মনোদৈহিক।
অর্থাৎ রোগের লক্ষণ দেহে প্রকাশ পেলেও এর উৎস হচ্ছে মন। আর বাকি ২৫ ভাগ রোগের কারণ জীবাণু সংক্রমণ, ভুল খাদ্য গ্রহণ, ব্যায়াম না করা এবং দৈহিক আঘাত, ওষুধ ও অপারেশনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। প্রশ্ন হতে পারে মনের কারণে কীভাবে দেহের রোগ হয়?আসলে মন যখন ভাবাবেগজনিত চাপ বা উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হয় তখন শরীর নানাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। রক্তে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণের পাশাপাশি হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, মলাশয়ের তৎপরতা বাড়ে, মূত্রাশয় সহজে সঙ্কুচিত হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে এটা ডায়রিয়া এবং প্রস্রাব বৃদ্ধির রূপ নিতে পারে। ব্রেন দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত নার্ভাস সিস্টেম আমাদের ত্বকের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। তাই ত্বকের ওপর আলতো করে স্পর্শ করে আদর করার মাধ্যমে শিশুদের শান্ত করা যায় আবার ত্বকে চিমটি কেটে সহজেই স্নায়ুকে উত্তেজিত করে দেয়া যায়। ‘ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া’ বা ‘লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া’ কথাগুলো ত্বকের ওপর মনের প্রভাবকেই নির্দেশ করে। তাই উৎকণ্ঠার কারণে স্কিন র্যাশের মতো চর্মরোগও হতে পারে।
ডা. হার্বার্ট বেনসন এবং ডা. এডমন্ড জ্যাকবসন এই টেনশন বা উৎকণ্ঠার কারণে সৃষ্ট রোগের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে:- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, বাতব্যথা, বিষণ্নতা বদমেজাজ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডায়রিয়া, বহুমূত্র, ঘাড়ে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা ইত্যাদি।
নিউরোসায়েন্টিস্টরা বলেছেন- টেনশন বা উৎকণ্ঠা বা স্ট্রেস হচ্ছে এমন এক রোগপ্রক্রিয়া বা মানসিক অবস্থা যা ব্রেনের বাস্তব কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে শারীরিক প
্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই শারীরিক প্রতিক্রিয়া আবার ব্রেনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। টেনশনে ব্রেন ও শরীরের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কাজ করে দুষ্টচক্রের মতো।উৎকণ্ঠা বা স্ট্রেসের প্রথম শারীরিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মুহূর্তে কাজে লাগানোর জন্যে বিভিন্ন পেশীকে শক্ত করে ফেলা। এই শক্ত পেশীগুলো আবার সাথে সাথে স্নায়ুর মাধ্যমে ব্রেনে খবর পাঠায়, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সে তৈরি। দৃশ্যত ব্রেন এই খবরকে ব্যাখ্যা করে তার আশঙ্কার প্রমাণ হিসেবে। অর্থাৎ ব্রেন তখন আরও নিশ্চিত হয় যে, সত্যিকারের দৈহিক বিপদ আসন্ন। তাই ব্রেন তখন প্রতিটি পেশীকে সজাগ হওয়ার জন্যে বার্তা পাঠাতে থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে রাসায়নিক বার্তা প্রেরণ করে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ এই ক্রমাগত অর্থহীন সতর্কীকরণের ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাতে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং রোগ নিরাময় ক্ষমতা হ্রাস পায়। একই সাথে দৈহিক ও মানসিক অস্বস্তি বাড়তে থাকে। পরিণামে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়।
দেহের ওপর মনের এই অনভিপ্রেত আক্রমণের দুষ্টচক্রকে আপনি শুধুমাত্র পেশীর আচরণ প্রক্রিয়া পাল্টে দিয়েই প্রতিহত করতে পারেন। পেশী উত্তেজিত ও শক্ত হয়ে উঠলে আপনি সচেতনভাবে পেশীকে শিথিল করুন। পেশী শিথিল হওয়ার সাথে সাথে সে ব্রেনে খবর পাঠাবে সব ঠিক আছে, কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। আর তখন ব্রেনও সতর্কাবস্থা প্রত্যাহার করবে। ব্রেনে পেশী থেকে যত কম সতর্কাবস্থার বাণী যাবে, ব্রেন তত বেশি পরিমাণে শিথিল হবে এবং এক পর্যায়ে সতর্কাবস্থা থেকে পরিপূর্ণ শিথিল অবস্থায় পৌঁছে যাবে। আর মন তখন উৎকণ্ঠার পরিবর্তে হবে প্রশান্ত। যে মন আপনার সর্বনাশ করতে যাচ্ছিল, তা-ই পরিণত হবে নিরাময়ের বাহনে।
No comments:
Post a Comment